(উড়োজাহাজের উড়ো চিঠি)
গাজী ভাইয়ের গাড়ি
শামীম শাহেদ
সবার মধ্যেই প্রচণ্ড উত্তেজনা। মাছ ধরতে যাব। আমি সোহেলকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এত সময় তোরা কোথায় পাস।’
সে বলল, ‘আমারা শুধু কাজটাই করি। ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতা আমাদের নাই।’
‘দিনে কতক্ষণ কাজ করতে হয়?’
‘আট ঘন্টা। এই আট ঘণ্টা পর আমাকে এক সেকেন্ড আটকে রাখার অধিকার অফিসের নাই। আবার আট ঘণ্টার মধ্যে আমরা ফোন ধরার সময়ও পাই না। সুইডেনে নতুন নিয়ম হচ্ছে। এই নিয়মে আমাদের কাজের সময় হবে ছয় ঘণ্টা।’
বাহ। আরামই আরাম।
সামারা আগে বাবার সঙ্গে মাছ ধরেছে। তাই সে আজকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। নোরা, জারা, অরোরা এবারই প্রথম। তাই তাদের উত্তেজনার সীমা নাই। নদী থেকে কীভাবে মাছ ধরা সম্ভব! তা আবার বর্শি দিয়ে! অজস্র প্রশ্ন তাদের মাথায়।
এখানে গাড়ি চড়ার একটা যন্ত্রণা (!) হচ্ছে সবাইকে সিট বেল্ট বাঁধতে হয়। শুধু সিট বেল্টই না। বাচ্চাদের জন্য বেবি সিটও কম্পলসারি। আমাদের দেশেও সিট বেল্ট বাঁধতে হয়, কিন্তু এখানে না বাঁধলে কঠিন শাস্তী। তিন হাজার সেক জরিমানা। বাংলাদেশের টাকায় ত্রিশ হাজার টাকার কাছাকাছি। নিচে বেবি সিট আর ওপরে সিট বেল্টি দিয়ে বাচ্চাদেরকে আটোসাটো করে বাঁধা হলো। প্রত্যেকের হাতেই একটা করে মাছ ধরার ছিপ। এই ছিপ হাতে নিয়েই নাকি তারা নদী পরযন্ত যাবে। গাড়ি হেলসিংবর্গের দিকে ছুটতে শুরু করল। গতি ঘণ্টায় একশ চল্লিশ কিমি। সোহেল ভালো ড্রাইভ করে।
গাড়িতে করে ঘুরতে যাওয়া নিয়ে আমার বিশেষ অভিজ্ঞতাটা ঢাকায়। ’৯৫ সালের কথা। রাকায়েত ভাইয়ের একটা লালচে গাড়ি ছিল। রাকায়েত ভাই মানে আমাদের গাজী রাকায়েত। নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা। গাড়িটা লালচে টাইপ বলছি কারন গাড়ির রঙ খয়ে গিয়ে তখন খয়রি হওয়ার পথে। গাড়িটার বিশেষ বৈশিষ্ট হচ্ছে গাড়ীর চারটা দরজার মধ্যে শুধু সামনে বা-দিকের দরজাটাই খোলে। বাকিগুলো খোলে না। সেই এক দরজা দিয়ে আমরা চার-পাঁচজন পিছনের সিটে উঠে বসি। তারপর রাকায়েত ভাই উঠে ড্রাইভিং সিটে বসেন। সবশেষ জন উঠে বাদিকের দরজাটা বন্ধ করে। তারপর আমরা ঘুরতে যাই। এটা নিয়ে আমাদের সে কি আনন্দ। সপ্তাহে তিন থেকে চারদিন এই গাড়িতে করে ঘোড়াঘুড়ি ছিল কম্পলসারি। কমন ঠিকানা এয়ারপোরটের সামনের ওয়াটার ফ্রন্ট রেস্টুরেন্ট। তখন এয়ারপোর্টের সামনে একটা রেস্টুরেন্ট ছিল। পানির মাঝখানে। নাম ছিল ওয়াটার ফ্রন্ট ।
নিয়মিত যাত্রী কে কে শুনবেন? নাট্যকার পান্থ শাহরিয়ার, অভিনেতা ইন্তেখাব দিনার, নির্দেশক অম্লান বিশ্বাস, নাট্যকার নজরুল ইসলাম, মাসুদ রানা, অমল বিশ্বাস কথা আর আমি। মাঝে মাঝে আফসানা মিমি আর টনি ডায়েসকেও এই গাড়িতে উঠতে দেখা গেছে।
রাকায়েত ভাই মহা উৎসাহে আমাদের নিয়ে ঘুরতে বের হতেন আর বিভিন্ন নাটকের গল্প শোনাতেন। একদিন বাংলামটর মোড়ে এসে গাড়ি আটকে গেল। আটকে গেল না বলে বলতে হবে থেমে গেল। রাকায়েত ভাই পিছন দিকে মাথা ঘুরিয়ে বললেন, ‘শোন আমি তোদেরকে শুধু ঘুড়াঘুড়ির জন্য গাড়িতে উঠাই না। গাড়ি কোথাও বন্ধ হয়ে গেলে গাড়ি ঠেলাটাও তোদের দায়িত্ব। যা গাড়ি ঠেল।’
কি আর করা। গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে বাংলামটরের ওই পারে নেওয়া হলো। কিন্তু রাকায়েত ভাইয়ের মুড অফ।
‘কি ব্যাপার রাকায়েত ভাই। কোনো সমস্যা?’
‘তেমন কোনো সমস্যা না। ট্রাফিক পুলিশ গাড়িটার দিকে তাকিয়ে হাসছিল বলে মনে হল।’
‘থাক বাদ দেন। তার মুখটাই বোধহয় এমন।’
তার কয়েকদিন পড়ের ঘটনা। শান্তিনগর পুলিশ লাইনের উল্টোপাশে গাড়ি রেখে রাকায়েত ভাই টেলিহোমে এডিটিং করছেন। বশির ভাইয়ের টেলিহোম তখন শান্তিনগরে ছিল। রাত দুইটায় এডিটিং থেকে বের হয়ে রাকায়েত ভাই দেখলেন তার গাড়ি নাই। এটা কোনো কথা হল। এত প্রিয় একটা গাড়ি চুরি হয়ে যাবে। সবাইকে ফোন করে অস্থির করে তুললেন রাকায়েত ভাই। ‘জানিস আমার গাড়িটা চুরি হয়ে গেছে।’
‘কি বলেন, এই গাড়ি কে নিবে।’ পান্থ শাহরিয়ারের উত্তর।
তার খুব গায়ে লাগল। রাকায়েত ভাই ফোন রেখে দিলেন। একটা পর পাশ থেকে দাড়োয়ান এসে বলল, ‘স্যার, গাড়ি তো চুরি হয় নাই। গলিতে ট্রাক ঢুকব। হেলপার জোড়ে টান দিল আপনের গাড়ির দরজা খুইলা গেল। তারপর ধাক্কায়া পাশের গলিতে নিয়া রাখছে।’
রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে রাকায়েত ভাই তখনই সিদ্ধান্ত নিলেন, এই গাড়ি আর রাখব না।
যেই ভাবনা সেই কাজ। আমার স্পষ্ট মনে আছে শেষে সেই গাড়ি বিক্রি করে সঙ্গে আরও পাঁচশ টাকা ভরে রাকায়েত ভাই একটা সাইকেল কিনলেন।
বিদ্র: ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা করবেন রাকায়েত ভাই। সত্যি কি আর চাঁপা থাকে বলেন!দিনার, পান্থ স্বাক্ষী। তবে ইউরোপে সাইকেলের অনেক কদর। মাছ ধরার গল্পটা আরেকদিন বলব।
আগস্ট ২০১৬
লুন্ড, সুইডেন।
Comments