হঠাত্ করে লন্ডন শহর থেকে একটি বাচ্চা মেয়েকে তুলে নিয়ে যায় একটি জায়েন্ট। দৈত্যটি দেখতে বিশাল আকৃতির, কিন্তু বয়স্ক। ছোট্ট মেয়েটির নাম সোফি। সোফি খুবই বুদ্ধিমতি একটি মেয়ে। খুব ঠাণ্ডা মেজাজের। বিএফজির সঙ্গে কথা বলে বলে সে তার বন্ধু হয়ে যায়। বিএফজির একটি গোপন মিশন আছে। সে ঘুরে ঘুরে সবার স্বপ্ন জড়ো করে। বিএফজির চেয়েও বড় একদল জায়েন্টকে দেখা যায়। এরা কেইনিবল। মানুষের মাংস খায়। একদিন সোফিকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাইনিবলদের দেশে হাজির হয় বিএফজি। তারা খেয়ে ফেলতে চায় সোফিকে। চমত্কার গল্প, চমত্কার গ্রাফিক্স, প্রজেকশন, প্রেজেন্টেশন। স্টিভেন স্পিলবার্গের ছবি। এই বছর মুক্তিপ্রাপ্ত আমেরিকান ছবি। চমত্কার অভিজ্ঞতা।
এখনকার ছেলেমেয়েরা কত ভাগ্যবান। চমত্কার সব ছবি দেখাতে পাচ্ছে তারা। আমাদের ছোটবেলায় এই ধরনের কোনো ছবি দেখার সুযোগই ছিল না। সিনেমা হলে গিয়ে আমার দেখা প্রথম ছবি ছিল ‘ছুটির ঘণ্টা’। আর একা একা বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে দেখা ছবি ছিল ‘জরিনা সুন্দরী’। অবাক হচ্ছেন? সে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। বাসা থেকে রেডিটেডি হয়ে বের হবো, আম্মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কই যাস?’
আমি সরাসরি বললাম, ‘সিনেমা দেখতে যাই।’
আম্মা বিশ্বাস করলেন না। বললেন, ‘যাহ! ফাজলামো করিস না। তাড়াতাড়ি চলে আসিস।’
আমি আর আমার মামা গিয়ে হাজির হলাম নরসিংদীর সুরভী সিনেমা হলে। ওয়াসিম আর সুচরিতার বড় বড় দুটি ছবি সামনে ঝুলছে। সুন্দর করে লেখা- জরিনা সুন্দরী চলছে। ঢুকে পড়লাম এখানেই।
প্রচণ্ড গরম। আশপাশে ঘামের গন্ধ। টুলের মতো একটি চেয়ারে বসে পড়লাম। সিনেমা শুরু হলো। দশ পনের মিনিটের মধ্যে ঘেমেটেমে শেষ। তাকিয়ে দেখলাম, মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। কিন্তু গায়ে একটুও বাতাস লাগছে না। আশ্চর্য ফ্যান ঘুরছে অথচ বাতাস লাগছে না। এটা কিভাবে হয়। সিনেমা হল গরম হলে গরম বাতাসই লাগুক। লাগবে তো!
মামা বিদ্রোহী ভঙ্গিতে বললেন, ‘সিনেমা না হয় না দেখলাম, কিন্তু বাতাস কেনা লাগে না এটা না দেখে আজকে ঘরে ফিরবো না।’
সিনেমা শেষ হলো। সবাই বের হলো। ফ্যান থামলো। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, ফ্যানের শুধু মাঝখানের গোল অংশটি আছে, তিনটি পাখা নেই।
‘জরিনা সুন্দরী’ দেখার কুফল কি হলো বলতে পারবো না। সুফল হলো, আমার সিনেমা দেখার বাতিক হয়ে গেল। এরপর এমন দিনও গেছে, সপ্তাহে চৌদ্দটি সিনেমা দেখেছি। তখন এক টিকেটে দুই ছবি দেখার বেশ চল ছিল। কিন্তু তখন আমাদের কোনো ‘বিএফজি’ ছিল না। আমাদের ছিল জাম্বু। বিগ ফ্রেন্ডলি জাম্বু। এক অর্থে অবশ্য তিনিও বিএফজি।
একটি জোক মনে পড়ে গেল।
মফস্বল শহরগুলোতে এটার খুব চল আছে। ইয়াং পোলাপান স্পিডব্রেকারের সামনে এসে দাঁড়ায়, যখন কোনো একটি বাস বা ট্রাক আসে তখন তারা সেটাতে উঠে পড়ে। পরে সুযোগ বুঝে একটি জায়গায় নেমে যায়। ভাড়া লাগে না। এ রকম একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে একটি স্পিডব্রেকারের সামনে। বাস বা ট্রাক এলেই উঠে পড়বে। রাত তখন এগারটা বাজে প্রায়। টিপিটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। একটি ট্রাক এলো, সে সেটাতে উঠে পড়ল। ট্রাকের ওপর ছিল একটি লাশ। বেওয়ারিশ লাশ। পাটি দিয়ে পেঁচিয়ে ট্রাকে করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাচ্ছিল। যে লোক স্পিডব্রেকারের সামনে থেকে উঠেছে সে তো আর এসব জানে না। সে দেখলো গাছের গুড়ির মতো একটা কিছু ট্রাকের ওপর রাখা। সে সেটাতে বসে সিগারেট টানতে লাগলো।
এদিকে ড্রাইভার তার পাশে বসা হেলপারকে বললো, ‘উকি দিয়া দেখতো লাশের কী অবস্থা?’
হেলপার পেছন দিকে তাকিয়ে অবাক, ‘ওস্তাদ, লাশ তো বইসা সিগারেট টানতেছে।’ -‘কছকি’। ট্রাক থামিয়ে পেছন দিকে তাকালো ড্রাইভার। দেখলো, সত্যি সত্যি লাশ বসে সিগারেট টানছে। ভয়ে ট্রাক ফেলে দু’জন দিল দৌড়। ট্রাকের ওপরে বসা লোকটি ভাবল নিশ্চয়ই কোনো একটা সমস্যা হয়েছে, তা না হলে এরা দৌড়ায় কেন? কিছু বুঝে উঠতে না পেরে সেও তাদের পেছন পেছন দৌড় দিলো। এটা দেখে হেলপার চিত্কার করে উঠল, ‘ওস্তাদ দৌড়ান, লাশ আইতাছে।’
আমাদের আশেপাশের এসব ঘটনা শুনলে স্পিলবার্গ নিশ্চয়ই অবাক হয়ে যেতেন। ভাবতেন, এরা জায়েন্ট না হতে পারে কিন্তু বেশ ফ্রেন্ডলি।
লুন্ড, সুইডেন থেকে