Travel

উড়োজাহাজের উড়োচিঠি বি এফ জি

এক মাসের ইউরোপ ট্যুরে আমার আর মুনের কাজ ছিল পথে পথে ঘুরে বেড়ানো আর সিনেমা দেখা। লুন্ড শহরে বেশ কয়েকটা থিয়েটার কম্পাউন্ড আছে। প্রতিটিতেই চার-পাঁচটি করে প্রজেকশন হল। খুব বেশি মারামারি আর ঝড়-ঝাপ্টার সিনেমা এখানে জনপ্রিয় হয় না। একটু শান্ত প্রেমের ছবি এখানে বেশি চলে। একটা ফিল্মের কথা এখানে সবার মুখে মুখে শুনতে পেলাম। নাম বিএফজি। বিগ ফ্রেন্ডলি জায়েন্ট।

হঠাত্ করে লন্ডন শহর থেকে একটি বাচ্চা মেয়েকে তুলে নিয়ে যায় একটি জায়েন্ট। দৈত্যটি দেখতে বিশাল আকৃতির, কিন্তু বয়স্ক। ছোট্ট মেয়েটির নাম সোফি। সোফি খুবই বুদ্ধিমতি একটি মেয়ে। খুব ঠাণ্ডা মেজাজের। বিএফজির সঙ্গে কথা বলে বলে সে তার বন্ধু হয়ে যায়। বিএফজির একটি গোপন মিশন আছে। সে ঘুরে ঘুরে সবার স্বপ্ন জড়ো করে। বিএফজির চেয়েও বড় একদল জায়েন্টকে দেখা যায়। এরা কেইনিবল। মানুষের মাংস খায়। একদিন সোফিকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাইনিবলদের দেশে হাজির হয় বিএফজি। তারা খেয়ে ফেলতে চায় সোফিকে। চমত্কার গল্প, চমত্কার গ্রাফিক্স, প্রজেকশন, প্রেজেন্টেশন। স্টিভেন স্পিলবার্গের ছবি। এই বছর মুক্তিপ্রাপ্ত আমেরিকান ছবি। চমত্কার অভিজ্ঞতা।

এখনকার ছেলেমেয়েরা কত ভাগ্যবান। চমত্কার সব ছবি দেখাতে পাচ্ছে তারা। আমাদের ছোটবেলায় এই ধরনের কোনো ছবি দেখার সুযোগই ছিল না। সিনেমা হলে গিয়ে আমার দেখা প্রথম ছবি ছিল ‘ছুটির ঘণ্টা’। আর একা একা বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে দেখা ছবি ছিল ‘জরিনা সুন্দরী’। অবাক হচ্ছেন? সে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। বাসা থেকে রেডিটেডি হয়ে বের হবো, আম্মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কই যাস?’

আমি সরাসরি বললাম, ‘সিনেমা দেখতে যাই।’

আম্মা বিশ্বাস করলেন না। বললেন, ‘যাহ! ফাজলামো করিস না। তাড়াতাড়ি চলে আসিস।’

আমি আর আমার মামা গিয়ে হাজির হলাম নরসিংদীর সুরভী সিনেমা হলে। ওয়াসিম আর সুচরিতার বড় বড় দুটি ছবি সামনে ঝুলছে। সুন্দর করে লেখা- জরিনা সুন্দরী চলছে। ঢুকে পড়লাম এখানেই।

প্রচণ্ড গরম। আশপাশে ঘামের গন্ধ। টুলের মতো একটি চেয়ারে বসে পড়লাম। সিনেমা শুরু হলো। দশ পনের মিনিটের মধ্যে ঘেমেটেমে শেষ। তাকিয়ে দেখলাম, মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। কিন্তু গায়ে একটুও বাতাস লাগছে না। আশ্চর্য ফ্যান ঘুরছে অথচ বাতাস লাগছে না। এটা কিভাবে হয়। সিনেমা হল গরম হলে গরম বাতাসই লাগুক। লাগবে তো!

মামা বিদ্রোহী ভঙ্গিতে বললেন, ‘সিনেমা না হয় না দেখলাম, কিন্তু বাতাস কেনা লাগে না এটা না দেখে আজকে ঘরে ফিরবো না।’

সিনেমা শেষ হলো। সবাই বের হলো। ফ্যান থামলো। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, ফ্যানের শুধু মাঝখানের গোল অংশটি আছে, তিনটি পাখা নেই।

‘জরিনা সুন্দরী’ দেখার কুফল কি হলো বলতে পারবো না। সুফল হলো, আমার সিনেমা দেখার বাতিক হয়ে গেল। এরপর এমন দিনও গেছে, সপ্তাহে চৌদ্দটি সিনেমা দেখেছি। তখন এক টিকেটে দুই ছবি দেখার বেশ চল ছিল। কিন্তু তখন আমাদের কোনো ‘বিএফজি’ ছিল না। আমাদের ছিল জাম্বু। বিগ ফ্রেন্ডলি জাম্বু। এক অর্থে অবশ্য তিনিও বিএফজি।

 

সিনেমা শেষ করে আমি আর মামা রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। রাত তখন দশটা। মফস্বল শহর। ঘুটঘুটে অন্ধকার। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। আশেপাশে একটা রিকশাও নেই। হঠাত্ দেখলাম একটা ট্রাক ধীরে ধীরে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ট্রাকটা চলছে কিন্তু ট্রাকের ভেতরে কেউ নেই। গা শিউরে উঠল। ড্রাইভার নেই, হেলপার নেই অথচ ট্রাক চলছে। ঘামতে শুরু করলাম। দৌড় দেবো কি-না ভাবতে ভাবতে ট্রাকটি সামনে চলে এলো। পাস করে যেতেই দেখলাম ড্রাইভার আর হেলপার মিলে ট্রাকটিকে পেছন থেকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছে।

একটি জোক মনে পড়ে গেল।

মফস্বল শহরগুলোতে এটার খুব চল আছে। ইয়াং পোলাপান স্পিডব্রেকারের সামনে এসে দাঁড়ায়, যখন কোনো একটি বাস বা ট্রাক আসে তখন তারা সেটাতে উঠে পড়ে। পরে সুযোগ বুঝে একটি জায়গায় নেমে যায়। ভাড়া লাগে না। এ রকম একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে একটি স্পিডব্রেকারের সামনে। বাস বা ট্রাক এলেই উঠে পড়বে। রাত তখন এগারটা বাজে প্রায়। টিপিটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। একটি ট্রাক এলো, সে সেটাতে উঠে পড়ল। ট্রাকের ওপর ছিল একটি লাশ। বেওয়ারিশ লাশ। পাটি দিয়ে পেঁচিয়ে ট্রাকে করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাচ্ছিল। যে লোক স্পিডব্রেকারের সামনে থেকে উঠেছে সে তো আর এসব জানে না। সে দেখলো গাছের গুড়ির মতো একটা কিছু ট্রাকের ওপর রাখা। সে সেটাতে বসে সিগারেট টানতে লাগলো।

এদিকে ড্রাইভার তার পাশে বসা হেলপারকে বললো, ‘উকি দিয়া দেখতো লাশের কী অবস্থা?’

হেলপার পেছন দিকে তাকিয়ে অবাক, ‘ওস্তাদ, লাশ তো বইসা সিগারেট টানতেছে।’ -‘কছকি’। ট্রাক থামিয়ে পেছন দিকে তাকালো ড্রাইভার। দেখলো, সত্যি সত্যি লাশ বসে সিগারেট টানছে। ভয়ে ট্রাক ফেলে দু’জন দিল দৌড়। ট্রাকের ওপরে বসা লোকটি ভাবল নিশ্চয়ই কোনো একটা সমস্যা হয়েছে, তা না হলে এরা দৌড়ায় কেন? কিছু বুঝে উঠতে না পেরে সেও তাদের পেছন পেছন দৌড় দিলো। এটা দেখে হেলপার চিত্কার করে উঠল, ‘ওস্তাদ দৌড়ান, লাশ আইতাছে।’

আমাদের আশেপাশের এসব ঘটনা শুনলে স্পিলবার্গ নিশ্চয়ই অবাক হয়ে যেতেন। ভাবতেন, এরা জায়েন্ট না হতে পারে কিন্তু বেশ ফ্রেন্ডলি।

লুন্ড, সুইডেন থেকে

Thanks a lot Qatar airways

ধন্যবাদ কাতার অ্যায়ারওয়েজ

qatarপ্রতিবার ইওরোপ টুরের আগে কোনো না কোনো ঝামেলা হবেই। এবারও হল। আগের গুলা পরে বলছি। এইবারেরটা আগে বলি।

যাত্রার শুরুর সময় থেকেই দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। সন্ধায় খবর এলো, ফ্লাইট ডিলেইড। প্রায় দুই ঘন্টা। বাসায় বসে থাকতে থাকতে রিপভ্যানউইঙ্কেল অবস্থা । চরম অনিচ্ছায় অ্যায়ারপোর্ট হাজির হলাম। সেখানেও অপেক্ষা। ঢাকা অ্যায়ারপোর্টের কোনাকান্ছি মুখস্ত হয়ে গেল। তখনই ধারনা করতে পারছিলাম এই চাঁপটা যেয়ে পড়বে ট্রান্জিটের ওপর।
কাতার অ্যায়ারওয়েজ সাধারনত এই জাতীয় সমস্যাগুলো চমৎকার ভাবে সামলায়। আরাই ঘন্টার ট্রান্জিটে দুই ঘন্টার ডিলেইড- বড় ধরনের চাঁপ অপেক্ষা করছে বুঝতে পারছিলাম।
ঘটলও তাই । কাতার অ্যায়ারপোর্টে প্লেন ল্যান্ড করার সঙ্গে সঙ্গে একজন এসে বললেন- আর ইউ মিস্টার শামীম ?
আমি ওপর-নিচ মাথা নেড়ে শেষ করার আগেই বললেন -ফলো মি।
তারপর ইউসাইন বোল্টকে পিছনে ফেলে ছুটলেন এই মাথা থেকে ওই মাথা। আমার পুরো পরিবার তখন টাইসন গেই। নোরা, জারা, অরোরা, মুন আর আমি সবাই তখন প্রৃথিবীর সেরা অ্যায়ারপোর্টের দৈঘ্র্যের ওপর প্রচণ্ড বিরক্ত।
বিশ মিনিট একটানা দৌড়ানোর পর হিন্দী সিনেমার মতো প্লেনে উঠলাম আমরা। হিন্দী সিনেমার মতো মানে, পুরো একটা আস্ত প্লেন যাত্রী বোঝাই করে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের জন্য। খুবই লজ্জা লজ্জা লাগল। প্লেন ভর্তি যাত্রীরা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, আমারা পাঁচজন সিটে গিয়ে বসলাম। সঙ্গে সঙ্গে প্লেন নড়তে শুরু করল।
তখন হঠাৎ মাথায় এলো বিষয়টা–আমাদের লাগেজ? আমাদেরকেই যদি এইভাবে দৌড়ে এসে প্লেনে উঠতে হয় আমাদের লাগেজ কিভাবে আসবে?
পরক্ষণেই আবার মনে হল–ধুর বোকাদের মতো কীসব আবোল তাবোল ভাবছি।
প্লেন ল্যান্ড করল কোপেনহেগেন অ্যায়ারপোর্টে। ডেনমার্ক।
ছয় নাম্বার বেল্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছি তিনটা লাগেজ আসার পর বাকিগুলার আর দেখা নাই। খুব চিন্তায় পড়ে গলাম। বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে এখন কী করি।
ব্যাগজ ক্লেইম কাউন্টারে জানাতেই লজ্জায় কাচুমাচু হয়ে গেল লোকটা। উই আর ভেরি সরি-জাতীয় কিছু কথা বলে কম্পিটার ঘাটাঘাটি করে জানালো-লাগেজ তিনটি দোহা থেকেই বিমানে ওঠানো সম্ভব হয় নাই।
-তাই ? তাহলে এখন কী করণীয় ? আমাদের লাগেজ হারিয়ে গেল?
শুরু হল সবার আহাজারি। আমাদের ভ্রমণ জীবনে এই ঘটনা এবারই প্রথম। আমরা যতটাই চিন্তিত ওই লোক ততটাই কাচুমাচু ।
-কোনো চন্তা করবেন না। আপনারা যেখানে যাচ্ছেন চলে যান, আমরা আপনাদের ঠিকানা মতো পৌঁছে দেব।
-বলে কি এই লোক, কোনো জিনিস হারলে আবার ফেরত পাওয়া যায় নাকি? আমাদের আহাজারি আর কমে না।
ঠিকানা-টিকানা দিয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত হ্রদয় নিয়ে অ্যায়ারপোর্টের বাইরের দিকে হাটতে শুরু করব তখনই আমাদের দিকে একটা খাম বাড়িয়ে দিলেন তিনি।
-এখানে এক হাজার সাতশ ডেনিস ক্রোনার আছে। কাতার অ্যায়ারওয়েজ এই অনাকাঙখীত ঘটনার দায় হিসেবে টাকাটা আপনাদের দিচ্ছে।
-বলেন কী! কেন! আমিতো অবাক। বাংলাদেশি টাকায় প্রায় বিশ হাজার টাকা।
-আপনাদের যদি জরুরী কিছু কিনতে হয়, তাই দিচ্ছে।
-বলেন কী, লাগেজ কি আর দিবেন না তাহলে। মুখ ফসকে বের হয়ে গেল কথাটা। সবাই হেসে উঠল। মনের আনন্দে টাকা নিয়ে বের হয়ে এলাম। পাশ থেকে মুন বলল, ওদেরকে বলনা ওরা চাইলে লাগেজ আরও কিছুদিন রেখে দিক।
দুই দন লাগেনি, পরদিন বিকেলেই ফোন এল, আপনাদের লাগেজ নিয়ে দশ মিনিটের মধ্যে আমরা বাসায় আসছি।
ধন্যবাদ কাতার অ্যায়ারওয়েজ । কৃতজ্ঞতা বিনয়, ভদ্রতা আর বিশ্বাসের প্রতি।
Privilege club no: 506475779.